Read more in Bengali
মিরিয়াম মেনকিনই হচ্ছেন প্রথম মহিলা, যিনি সফল ভাবে টেস্ট টিউবের মধ্যে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর নিষেক ঘটিয়েছিলেন। আর এই ভাবেই বদলে দিয়েছিলেন জনন সংক্রান্ত চিকিৎসার সংজ্ঞাই। তবে কিছু হাতেগোনা লোকজন আজ তাঁর নাম জানেন।
মিরিয়ামের গল্প
১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক মঙ্গলবারের এক রাত। কোলে কয়েক মাসের শিশুকন্যা। সবে দাঁত উঠতে শুরু করেছে একরত্তির। শিশুসন্তানের সেই যন্ত্রণা উপশম করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এক মা। কার্যত সে দিন মেয়ের দেখভালের জন্য গোটা রাতটাই জেগে কাটাতে হয়েছিল ৪৩ বছর বয়সি ওই ল্যাব টেকনিশিয়ানকে। পরের দিন সকাল হতেই ল্যাবে চলে যান তিনি। অন্যান্য দিনের মতোই শুরু করলেন গবেষণা। একটি কাচের পাত্রে শুক্রাণুর মিশ্রণে রাখলেন নতুন একটি ডিম্বাণু, ঠিক যেমনটা রোজ করে থাকেন। সেই সঙ্গে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যেতে লাগলেন, এ যাত্রা যেন শুক্রাণু আর ডিম্বাণু- এই দুইয়ে মিলে এক হয়ে যায়! আসলে হাভার্ডের ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ জন রকের এই ল্যাব টেকনিশিয়ান ও সহকর্মীর তখন একটাই ধ্যানজ্ঞান, মানুষের শরীরের বাইরেই ডিম্বাণুর নিষেক ঘটানো! যাতে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় আমূল পরিবর্তন আসে। অন্যান্য দিন ডিম্বাণু ও শুক্রাণু আধ ঘণ্টা মতো একসঙ্গে রেখে দিতেন তিনি। কিন্তু এ বার তা হল না! আগের রাতে জাগার ক্লান্তি আর ডিম্বাণু-শুক্রাণুর নিষেক দেখতে বিভোর হয়ে গিয়ে সে দিন ঘড়ির দিকে তাকাতেই বেমালুম ভুলে গেলেন। যখন খেয়াল হল, তখন দেখলেন যে, ততক্ষণে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। সে দিনকার মতো গবেষণা শেষ হল। এর পর শুক্রবার আবার তিনি ল্যাবে গেলেন। আর এসে যা দেখলেন, তাতে তার চক্ষু ছানাবড়া! তাঁর সামনে তখন যেন এক অপার বিস্ময়! তিনি দেখলেন, কোষগুলি ধীরে ধীরে বিভাজিত হতে শুরু করেছে। আর গোটা বিশ্বে এই প্রথম মানবদেহের বাইরে কাচের ভিতরেই ভ্রূণ তৈরি হল। আর তার প্রথম নিদর্শনের সাক্ষী রইলেন মিরিয়াম মেনকিন।
মেনকিন্সের এই কৃতিত্ব জনন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে এক নতুন যুগ এনে দিয়েছিল, তা অনস্বীকার্য। তবে তাঁর সাফল্য কিন্তু কোনও দুর্ঘটনা ছিল না। আসলে তিনি ছিলেন এক জন বিজ্ঞানমনস্ক ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী বিজ্ঞানী গবেষক। কিন্তু সহকর্মী রকের মতো তাঁর নাম নিয়ে ঘরে ঘরে চর্চা হয় না। আজও অনেকে জানেনই না মেনকিনের নাম।
এর পর আসি ১৯৭৮ সালের কথায়। সেই বছরই বিশ্বের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি লুইস ব্রাউন পৃথিবীর আলো দেখে। যদিও স্যর রবার্ট এডওয়ার্ডস এবং প্যাট্রিক স্টেপটোকেই আইভিএফ পদ্ধতির পথপ্রদর্শক বা জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে তার সঙ্গে নার্স এবং এমব্রায়োলজিস্ট জিন মারিয়ান পার্ডি-র নাম অবশ্যই নিতে হবে। কারণ এ ক্ষেত্রে তাঁরও সমান অবদান রয়েছে। পার্ডিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এমব্রায়োনিক কোষ বিভাজনের প্রথম সাক্ষী ছিলেন। আর বিশ্বের প্রথম আইভিএফ ক্লিনিক, বর্নহল ক্লিনিকের সহ-প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন এই পার্ডি-ই। অথচ, পার্ডিরও নামও সে রকম ভাবে বহুল চর্চিত নয়। ফিজিওলজি এবং মেডিসিনে নিজের অবদানের জন্য এডওয়ার্ড নোবেল পুরস্কারে-এ ভূষিত হয়েছেন। অথচ, সেই কৃতিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন পার্ডি। দুঃখের বিষয় যে, পার্ডির অবদানও অবহেলিত হয়ে একটা অন্ধকার কোণে পড়ে থেকেছে! এ বার সময় এসেছে সেই পর্দাটা সরানোর। সারা বিশ্বের হিসেবে দেখা গিয়েছে, সেই ১৯৭৮ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত আইভিএফের মাধ্যমে প্রায় ৬০ লক্ষ বাচ্চা কনসিভ করা হয়েছে। আসলে আশ্চর্য বিষয়টা হচ্ছে যে, এক সময় আইভিএফের ক্ষেত্রে মহিলা বিজ্ঞানী-গবেষকরা প্রদীপের আলোর তলায় পড়ে ছিলেন, যা সাম্প্রতিক কালে ধীরে ধীরে আলোর সম্মুখে উন্মোচিত হচ্ছে! আর তাই আজ মানুষ জানতে পারছে, এই মহিলা বিজ্ঞানীদের নাম এবং তাঁদের কালজয়ী, যুগান্তকারী কৃতিত্বের কথা। যাঁদের জন্য আজ কোল ভরছে বন্ধ্যত্বে আক্রান্ত বহু মহিলার।